আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ( বেড়ে উঠার গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৮:২৫:২৯ সকাল
পড়ার টেবিলটা ছোট বাবুদের মত সাজানো।
দোতলা পড়ার টেবিল। উপরের অংশে মোট দু'টো ভাগ। বিভিন্ন ধরণের ছোট ছোট শো-পিস দিয়ে সাজানো। একপাশে সুন্দর একটি টেবিল ল্যাম্প। দুটো কলমদানিতে রঙ বেরঙের সাইন পেন, মার্কার ও বল পেন ভর্তি। একপাশে একটি সুদৃশ্য মোবাইল। সুন্দর মলাট করা বইগুলোর দিকে তাকালে সহজে চোখ ফিরানো যায় না। কম্পিউটারে বানানো স্টীকারে নাম লিখা রয়েছে। সুন্দর ভাবে সাজানো একটি পড়ার টেবিল।
কিন্তু যার টেবিল সে অদূরেই বিছানায় শুয়ে আছে। এমন ভঙ্গীতে এবং বিছানাটা এতোটা এলোমেলো যে টেবিলটার মালিক যে সে, প্রথম দেখায় সেটা কেউ বিশ্বাস করতে চাবে না। এই সম্পুর্ণ বিপরীত স্বভাবের মেয়েটির নাম মুনা। এবারে জে এস সি পরীক্ষা দিবে। সকাল ১০টা থেকে স্কুল শুরু। এখন ৯টা বাজে। অথচ ঘুম থেকে উঠার কোনো নাম নেই।একেবারে বাবার মত আলসে ও ঘুমকাতুরে হয়েছে। ওর মা কয়েকবার এসে ডেকে গেছে। সেই আটটা থেকে ডেকে যাচ্ছে। কিন্তু উঠার নামই নেই। একবার শুধু এপাশ থেকে ওপাশে ফিরল। আর প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাবার আগে বলে যায়, ' আম্মু, আমাকে ভোর পাঁচটায় ডেকে দিও তো।' এলার্ম ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রিনা ওর মাথার পাশে রেখে দেয়। কিন্তু প্রথম শব্দটা হবার সাথে সাথে কীভাবে যেন এলার্ম ক্লকটা বন্ধ করে দেয়।এরপর পড়ে পড়ে ঘুমায়। ঠিক সাড়ে ন'টার দিকে নিজেই উঠে পড়ে। এরপর এতো দ্রুত নিজেকে তৈরী করে যে, সেটা একটা দেখবার মত দৃশ্য। রোজকার এই রুটীন।
রিনা আগে একটা স্কুলে জব করতো। কিন্তু মুনার ছোট ভাইটা হবার পরে সেই যে চাকরী ছেড়েছ্ আর নতুন করে কোথায়ও জয়েন করেনি। শিহাব এখন চার বছরের। এই এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে রিনা ও হাসানের সংসার। হাসান একটা ইন্ডেন্টিং ফার্মে চাকরী করে। সকালে বাসা থেকে নিজের হোন্ডায় চড়ে বের হয়। আসে অনেক রাতে। এভাবেই চলছে ওদের জীবনটা... টক-ঝাল-মিষ্টি'র মিশেলে... বেশ ভালোভাবেই। মায়ের সাথে মুনার সম্পর্কটা বাবার থেকে বেশী কাছের। মাকে ঘিরেই তার জগত। বয়ঃসন্ধিকাল এখন মুনার। শিশু থেকে কীভাবে যেন কিশোরীতে পরিণত হয়ে গেলো সে।
আজও সাড়ে ন'টায় ঘুম থেকে উঠে একটা সাইক্লোনের মতো সব কাজ সেরে স্কুল ব্যাগটা এক সাইডে ঝুলিয়ে স্কুলের দিকে রওয়ানা হল। গত বছরও ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েই চলেছে। একটা শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তন মুনার পিঠের ব্যাগটাকে এখন সাইডে নিয়ে এসেছে। আরো কিছু পরিবর্তন হয়েছে যেটা মুনা নিজেও জানে না। রিনার চোখে অবশ্য কিছু কিছু ধরা পড়ছে। আর পড়ছে রাস্তার দোকানগুলোতে বসে থাকা বখাটে ছেলেগুলোর চোখে যাদেরকে এই কিছুদিন আগেও সে 'ভাইয়া' ডেকে এসেছে। তখন তো তারা ওর দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকায়নি। শরীরের একটি যায়গায় সামান্য মাংস স্ফীত হওয়াটাই কি মুল কারণ? মুনা অনেক ভেবেছে ভাইয়াদের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে। শুধু কি এই ভাইয়ারা? স্কুলের যে স্যারদের কাছে সে টিউশন নিতে যায়, সেখানেও এই বিপত্তি। আগে স্যারদের হাত ওর শরীরের এখানে ওখানে লাগত। কখনো পিঠে হাত দিয়ে স্যারেরা বাহবা জানাতেন। কই, তখন তো কোনো অনুভুতি জাগেনি... এখনকার মত!
এখন কেমন লাগে?
নিজেকে জিজ্ঞেস করে?
অন্যরকম... ভাল ও খারাপের মাঝামাঝি এক বোধ কাজ করে। আগে সব স্যারকে একই রকম লাগত। কিন্তু ইদানিং আর সেরকম লাগছে না। স্যারদের ভিতর এমন ক'জন আছেন যাদের দিকে তাকালেও এক অজানা ভাললাগার অনুভুতিতে আচ্ছন্ন হয় সে আজকাল। তবে যখনি এই অনুভুতি নিজের ভিতরে ফীল করে, তখনি কেন জানি নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হয়... কি একটা গোপন কাজে সে যেন জড়িয়ে পড়েছে এমন মনে হয়। সে যে কারো সাথে এই কথাগুলো শেয়ার করবে তারও কোনো উপায় নেই। বন্ধুদের সাথে কোনো কিছু শেয়ার করতে ইচ্ছে করে না। বন্ধু বলতে তো সবাই... সেই নার্সারী থেকে ওরা সবাই এক সাথে আছে। ছেলে-মেয়েরা একই রুমে পাশাপাশি না বসলেও সবার সাথে সবার দেখাদেখি তো হয়। এর ভিতরে চোখাচুখি... একটু হাসি বিনিময়! কিন্তু কিসের জন্য যে এই হাসি, সেটা না জেনেই ওরা বড় হচ্ছে। তবে মেয়ে বন্ধুদের ভিতরে কয়েকটা বয়সের থেকে একটু বেশী পেকে গেছে। সেগুলোর সাথে এখন আর মুনা ইচ্ছে করেই বসে না। মিশতে ও মন চায় না। কিন্তু সেই বাবু বেলার বান্ধবী সবাই। মন না চাইলেও থাকতে হয়। শরীরে শিরশিরে অনুভুতি আনা কথা বার্তাও শুনতে হয়। এরা এতোটাই পাকনা যে স্যারদেরকে ও রেহাই দেয় না ওদের তীর্যক কমেন্টের আওতা থেকে।
হেঁটে হেঁটে স্কুলের কম্পাউন্ডে চলে এলো। আসার পথে সিনিয়র ক'জন ভাইদের সাথে দেখা। হাসিমুখে ওকে 'কেমন আছ' ... ' কোনো সমস্যা আছে কিনা' জানতে চাইল তাঁরা। অনেক কষ্টে হাসি চেপে তাদেরকে উত্তর দিয়ে চলে এলো। এরা সবাই ইদানিং নিজেদেরকে বয়স্ক বানানোর জন্য কতই না চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভালোভাবে এখনো দাড়িগোঁফ উঠে নাই অনেকেরই। অথচ ফ্যাশনদুরস্ত এবং বলিউডের নতুন চিংড়ি মার্কা নায়কদের মত অনুকরণ করে সেভাবেই নিজেদেরকে উপস্থাপনের চেস্টা করছে।
মুনাদের ক্লাশ টীচার হাবিব স্যার এখনই ঢুকলেন। ওকে দেখে কাছে ডাকলেন। আগে হলে ওর গাল টেনে দিতেন... মাথায় ও পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন। এই স্যারের কাছে এখনও প্রাইভেট পড়ে সে। কিন্তু ইদানিং আর আগের মত গাল টেনে দেন না। শুধু একটু হেসে বলেন, ' কেমন আছ মা?'
সে তাহলে বড়ই হয়ে গেছে!
বেশ বড় হয়েছে। সেদিন ওর বাবা ডেকে বললেন, ' এখন বড় হয়েছ তুমি। পথে ঘাটে কারো সাথে আর আগের মতো কথা বার্তা বলবে না। বুঝেছ?' সে না বুঝেই বলল, ' হ্যা আব্বু।' অথচ এই কিছুদিন আগে এই আব্বুই বাড়ীওয়ালার ছেলে যে ওর থেকে এক ক্লাস উপরে পড়ে, তার সাথে প্রতিদিন স্কুলে যেতে বলতেন। অথচ এখন মানে যেদিন থেকে ওড়না পরা শুরু করেছে সেদিন থেকেই ওর চেনা-জানা জগতটাই কেমন যেন অচেনা হয়ে গেলো। খুব দ্রুত সবকিছু বদলে যেতে থাকলো। ছোটবেলায় আম্মুকে কত বলেছে ওকেও ওড়না কিনে দিতে। অথচ এখন যখন বাধ্যতামুলক ভাবে সেটা পড়ার জন্য চাপ এলো, এখন আর পরতে ইচ্ছে করে না। কেন জানি হিন্দী সিরিয়ালের উঠতি মেয়েদের মত ওড়না গলায় ঝুলিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। তবে সেটা আয়নার সামনে কয়েকবার করেও দেখেছে। কিন্তু নিজেকে কেন জানি সেই মেয়েগুলোর মত লাগেনি। কেমন বিশ্রী ভাবে ওর বুকের নরম স্ফীত মাংসপিন্ড দু'টি দেখা দিচ্ছে! এটা দেখেও ওর মনটা কেন জানি খারাপ হয়ে গেলো।
ওর প্রিয় বান্ধবীদের একজন মিতা। ওর পাশেই গিয়ে বসল। আজ কেন জানি মন খারাপের দিকেই যাচ্ছে বারবার। এরকম হয় মুনার... প্রায়ই। তবে সেটা বেশীক্ষণ থাকে না। আজ কি জন্য জানি থেকে থেকে মন খারাপের দিকেই উড়ে যেতে চাচ্ছে। এমন সময় 'কেউ' যদি পাশে থাকত! একটু চমকে উঠল। কেউ মনে হল কেন? আবার ভাবতে বসে... এই কেউ কে হতে পারে? আব্বু ? আম্মু? শিহাব তো হবেই না। তবে কে? ভাইয়াদের কেউ? নাকি ওকে দেখে শীষ দেয় সেই রাস্তার অচেনা ছেলেদের কেউ?
উফ!
একটু শব্দ করেই বলে ফেলল কথাটা। মিতা ফিরে তাকালো। বল, ' কি হল!' একটু অবাক হল। বলল, ' নাহ! কিছু না।'
ইদানিং মুনার কাছে এরকম মনে হয়। ওর জীবনে আব্বু-আম্মুকে ছাড়িয়েও একটা অচেনা মানুষ একজন 'কেউ' হয়ে উঠছে... ধীরে ধীরে। মুনা নামের উচ্ছল একটি মেয়ে কীভাবে যেন তার উচ্ছলতা হারিয়ে শামুকের মত নিজে নিজের গতিকে স্লথ করে দিচ্ছে! ঝিনুকের মত নিজেকে গুটিয়ে রাখছে অনুভুতির খোলসে। আগে আব্বু-আম্মুর সাথে একই বিছানায় ঘুমাতো। সেই সিক্সে পড়া পর্যন্তও। একা একা অন্য রুমে ঘুমাতে ভয় লাগত। কিন্তু যেদিন এক রাতে ঘুম ভেঙ্গে চীরচেনা আব্বু-আম্মুকে অন্যরুপে দেখতে পেল, ওর চিন্তার জগতটাই ভেঙ্গে গেলো! কিন্তু কারো সাথে এই ব্যাপারে শেয়ার করতে না পারায় ভিতরে ভিতরে গুমরে মরতে লাগল। আর সিক্সের একজন মেয়ের সাথে কেই বা এই ব্যাপারে কথা বলতে আসবে। তবে এরপর থেকে সে নিজেই কেমন যেন এক নেশায় জড়িয়ে গেলো। একটা গোপন ও আদিম ক্রীড়ায় মত্ত এক দম্পতির নীরব সাক্ষী সে হয়ে রইল কিছুটা আলোআঁধারি পরিবেশের ভিতর। সরাসরি না দেখে শুধুমাত্র অনুভুতির সাহায্যে... কিছুটা গভীর নিঃশ্বাস প্রক্ষেপনের দ্বারা আর খাটের কম্পনের মাধ্যমে। আর মটকা মেরে পড়ে থেকে থেকে এই অন্যায় কাজটি করার জন্য পরের দিন একা একা বোবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়া। একটা মানসিক রোগীতেই পরিণত হয়ে যেত সে। কিন্তু কীভাবে যেন রিনা একদিন বুঝে ফেলল। এরপর থেকে ওকে আলাদা রুমে পাঠিয়ে দিল। তবে রিনা নিজেও মুনা না ঘুমানো পর্যন্ত থাকত। তবে রাতে ওর পাশ থেকে ওর আম্মু যে উঠে চলে যায় সেটাও বুঝতে পারত। তবে ততদিনে নারী-পুরুষের মধ্যকার গোপন ব্যাপারটি অনেকটা ওর বুঝে এসে গেছে।
তবে সবচেয়ে বড় বুঝটি এসেছে ওর নিজের মেয়েলি সমস্যাটির প্রথম দিনটিতে। ভাগ্য ভাল সেদিন স্কুল ছিল না... বাসায় ছিল। এমন সময়ে... রিনাই ট্যাক্টফুলি পুরো ব্যাপারটা সামলায়। একজন মা ই পারে এসব ব্যাপারে মেয়েদেরকে সাহায্য করতে। তবে মেয়ে হওয়ার যে এতো ধকল ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারছে। আর সামনে যে আরো এরকম অপেক্ষা করছে সেটাও উপলব্ধিতে আসছে। আর এই ধকল কাটাতে ওর যে আব্বু-আম্মু ছাড়াও একজন 'কেউ'কে প্রয়োজন সেটা ও কীভাবে যেন জেনে গেছে।
ওদের এইটা স্কুল ও কলেজ। কলেজের অনেক ভাইয়াকে সে চিনে। স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে সে খুব সুন্দর নাচত। নাচে প্রতিবারই সে তার বিভাগে প্রথম হয়ে এসেছে। সেই ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত। এখন আর আব্বু নাচতে দেন না। ভাইয়ারা ওর নাচ দেখে আসছে ওর ছেলেবেলা থেকেই। সেদিক দিয়ে অনেকেই ওকে চিনে। তবে ইদানিং ওর কাছে আসলে সবাই কেমন যেন হয়ে যায়। সেই ছোট্ট মুনা যে এখন আর সেই মুনায় নেই। তবে তাদের ভিতর এবার ইন্টার পরীক্ষা দিবে একজন রয়েছে যাকে 'ভাইয়া' ডাকতে ইচ্ছে করেনা মুনার। সেও ওর কাছে আসলে অন্যদের মত 'কেমন জানি' হয়ে যায় না। পাওয়ার ওয়ালা চশমা পড়া এই ছেলেটির নাম আদনান। প্রতিদিন ছুটির সময় একবার হলেও মুনার সাথে অর কীভাবে যেন দেখা হয়ে যায়...
আর তখন...
এক ভিন্ন অনুভুতির দোলায় মুনা নামের সদ্য কিশোরি মেয়েটি দুলে ওঠে!
স্কুল কম্পাউন্ডের কৃষ্ণচুড়ার লাল ফুলগুলোকে তখন আরো লাল মনে হয়!...
নীলাকাশের সাদা মেঘ বালকদেরকে আরো শুভ্র মনে হতে থাকে!!...
বিশাল দীঘির কালো পানিকে কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ ও শীতল মনে হয়... যেখানে ডুব দিলে শান্তি পাওয়া যাবে এরকম লাগে!!!
কেন এমন মনে হয় সেটা কখনো ভাবার চেষ্টা করেনা সে। তবে যেদিন আদনানের দেখা পায় না সেদিন মনটা যে ভীষণ খারাপ হয়ে যায় এটা টের পায়।
আর প্রতিদিন মাঠের পাশে একা আদনান বসে থাকে।
ওর অপেক্ষায়... এটা বুঝতে পেরে মুনার জগতে আলোড়ন তুলে একটা উপলব্ধি ভেসে বেড়ায়...
আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!
বিষয়: সাহিত্য
১১৭৯ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনিও ভালো থাকবেন।
শুভ কামনা রইলো।
ভালো থাকবেন।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
ভালো থাকবেন।
চালিয়ে যান-
অনেক অনেক শুভেচ্ছা...
শুভেচ্ছা আপনার জন্য নিরন্তর।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
শুভেচ্ছা আপনার জন্য নিরন্তর।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
আপনার সাথে সহমত।
অনেক শুভেচ্ছা রইল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন